ফলো আপ : হাজীপুরে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সংঘর্ষ : প্রতিবন্ধি কিশোর রহস্যজনক খুন
স্টাফ রিপোর্টার॥ মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক শারিরিক ও বাক প্রতিবন্ধি আরিফ (১৫) নামের এক কিশোর রহস্যজনক ভাবে খুন হয়েছে। খুনের এ ঘটনায় এলাকায় একপক্ষ অপরপক্ষকে গায়েল করার নানা গুঞ্জন শুনা যাচ্ছে। সুষ্ট তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে প্রতিবন্ধি খুনের মূল কারণ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে শনিবার (২৪ জুন) হাজীপুর গ্রামের হাজীবাড়ির একটি যৌথ পুকুরে ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে থালা-বাসন ধোয়া নিয়ে মেয়েদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধে, পরে তা ২ বাড়ির পুরুষদের মধ্যে গড়ালে ইফতার সময় উভয় পক্ষের মধ্যে ইট পাটকেল ছোঁড়াছুরির ঘটনা ঘটে। এ সময় উভয় পক্ষের ৫/৬ জন আহত হয়েছে। এলাকাবাসী রাত ৮. ১০ মিঃ আহত আরবেস আলী, ফয়েজ আহমদ, আলেক মিয়া, ইদন মিয়া, রিমন ও রওশন আক্তারকে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে আসলে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়।
সংঘর্ষের খবর পেয়ে শ্রীমঙ্গল থানার এস আই রফিকুল ইসলাম সহ একদল পুলিশ ঘটনা স্থলে রাত সাড়ে ৮টায় পৌছালে আহত কিংবা নিহত কাউকে ঘটনাস্থলে পাননি। এসময় আরিফের মা ফোয়ারা বেগম পুলিশের কাছে জানায় তার ছেলেকে মারধার করে পার্শবর্তী এলাকার হাজী মনির মিয়া, দুলাল, সানু, কনু মিয়া অপহরণ করে নিয়ে যায়। পুলিশ ঘটনাস্থলের বাড়ী থেকে বের হয়ে হাজীপুর বাজারের একটি দোকানে বসে এলাকার লোকজনের সাথে সংঘর্ষের কারণ ও হতাহতের নাম সংগ্রহ করেন। অপর দিকে প্রতিবন্ধি অপহরণের বিষয়টি অধিকগুরুত্বে খুজতে বের হন শ্রীমঙ্গল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম নজরুল ইসলাম। পরে রাত ১০টায় মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের বারান্ধায় কয়েকজন একটি সিএনজি অটোরিক্সা থেকে নামিয়ে রেখে আসে প্রতিবন্ধি কিশোরের মৃতদেহ। পরে শ্রীমঙ্গল থানার ওসি সহ একদল পুলিশ সদর হাসপাতালে গেলে মৃতদেহ দেখতে পান।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একই বাড়ির জহুর আলীর স্ত্রী শিল্পী বেগম মুঠোফোনে বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি ঘরে রান্নায় ছিলাম, ইট পাটকেল (ইটা-ইটির) ছোঁড়াছুরির শব্দ শুনে বাহিরে আসি। প্রথমে মারামারির ঘটনা জানা ছিলনা, তাদের ইটা-ইটির সময় আরিফের চাচা ইয়াকুত মিয়া একটা বাঁশের লাটি হাতে নিয়ে তার ভাতিজা প্রতিবন্ধি ছেলের উপর আঘাত করলে শারিরিক ও বাক প্রতিবন্ধি কিশোর আরিফ হোসেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মাটিতে পড়ে যাবার পর তাকে টেনে ঘরের বারান্দায় নিয়ে রাখা হয়। এর কিছুক্ষন পর কয়েকজন একটি সিএনজি গাড়ীতে তোলে নিয়ে যায়। এসব করা হয়েছে আমাদের হত্যা মামলায় ফাঁসাইতে।
শিল্পী বেগম আরো বলেন ‘তারা আমাদের সাথে সবসময় দুশমনি করে, নিজ ভাতিজা মেরে আমাদের ফাঁসাতে চাচ্ছে। ‘আমি এখন আর ঘরে-দুয়ারে যেতে পারছি না, তারা গালাগালি করে, আমাকে মেরে ফেলার হুমকী দিচ্ছে। আমার অপরাধ আমি পুলিশকে স্বাক্ষী দিছি কেন, কিন্তু আমি যা দেখছি তাই বলেছি-আল্লার কাছে তো একদিন জবাব দিতে হবে, আমারও বাচ্চা আছে, একজনের বাচ্চার জন্য যদি মিথ্যা বলি তাহলে আমার বাচ্চার জন্য এমনও হতে পারে। সত্য স্বাক্ষী দেয়ার কারনে তারা আমার স্বামী জুহুর মিয়াকে আসামী করেছে। আমাকে গালাগালি করে, তারা আমার দরজার গ্রীলে তালা লাগিয়ে রেখেছে, প্রানের ভয়ে নিজ ঘরে সেহরি না খেয়ে রোজা রেখেছি। ওসি সাহেব বলেছে বাড়িতে থাকতে কিন্তু এদের আতঙ্কে বাড়িতে থাকতে পারছি না।
অপর প্রত্যক্ষদর্শী সাবেক ইউপি সদস্য ও পল্লী চিকিৎসক খালেক মিয়ার সাথে ২৫ জুন সকালে মুঠোফোনে জানান, ইফতারের আগে পুকুর ঘাটে থালা বাসন ধোয়া নিয়ে বাড়ির বৌ-ঝিদের ঝগড়া হয়, ঘটনার সময় আমি বাড়িতে রোগী দেখছিলাম। এসময় ২০/২৫ জন লোক উভয় পক্ষের মধ্যে ইট পাটকেল ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে আরিফের চাচা ইয়াকুত আলী (৪৫) প্রতিবন্ধি কিশোরকে বাঁশের মুথা (মুগুর) দিয়ে মেরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়।
খালেক মেম্বার আরো জানান, এলাকার সামছুল হক (সিএসজি চালক), বিল্লাল মিয়া, মসকুল মিয়া, ইয়াকুত মিয়া একটি সিএনজি অটোরিক্সা করে কিশোর প্রতিবন্দিকে রাত ১০টায় মৃত অবস্থায় হাসপাতালে রেখে চলে আসে।
আব্দুল খালিকের পুত্র উজ্জল জানান একই বাড়ির লোকজনের মধ্যে পুকুরের পানিতে বাসন ধোয়া নিয়ে আজমত মিয়া অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। ইফতারের কিছু পূর্বে হওয়ায় উজ্জলের বাবা আব্দুল খালিক গালিগালাজ না করার জন্য বারণ করেন। পরে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে ইট পাটকেল ছোড়া হয়। এসময় চাচা ইয়াকুত আলী প্রতিবন্ধি কিশোরকে ঘর থেকে কুলে করে উঠানে এনে রেখে ঘরে চলে যান। আমাদের কেউ প্রতিবন্ধির উপর ইট পাটকেল মারেনি। পরে প্রতিবন্ধির মা টেনে হেঁচরে তাকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার সময় চাচা ইয়াকুত আলী শক্ত লাটি দিয়ে প্রতিবন্ধি আরিফের মাথায় আঘাত করেন। তাদের সাথে পূর্ব থেকে জমি জমাসংক্রান্ত বিরোধ রয়েছে উজ্জলদের। একই বাড়িতে বসবাস করলেও তাদের সাথে আমাদের আত্মীয়তার কোন বন্ধন নেই। হাজী মনির মিয়া সহ আরো কয়েক জন মারামারি শেষে প্রতিবন্ধি আরিফকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে উজ্জল বলেন তাদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে গ্রামের শেষ প্রান্তে। তারা কেই এই মারামারিতে ছিলেননা, বাড়ির লোক জনের মধ্যে মারামারি হয়।
অপরদিকে ঘটনার অভিযুক্ত ইয়াকুত আলীর সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তার প্রতিবন্ধি ভাতিজা আরিফ হত্যাকান্ডে সে জড়িত নয়। তিনি এদিন স্থানীয় মসজিদের ছাদে মহল্লার ইফতারের আয়োজন ছিল। তিনি ভৈরব বাজার থেকে বাড়ি ফিরে গন্ডগোল দেখে উভয় পক্ষকে নিবৃত করার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, মারামারির সময় এলাকার হাজী মনির মিয়া, দুলাল, সানু, কনু মিয়া, মাওঃ মাহফুজ প্রতিবন্ধি আরিফের বাবাকে মারপিট করছিল। বাবাকে মারতে দেখে আরিফ বাবার কাছে এগিয়ে গেলে আরিফকে তারা লাঠি দিয়ে আঘাত করে। নিহত আরিফকে কারা আঘাত করেছে জানতে চাইলে ইয়াকুত আলী মুঠোফোনে বলেন, ‘আগের যাদের নাম বললাম তারাই আরিফকে মেরেছ। এক প্রশ্নের জবাবে ইয়াকুত আলী এই প্রতিনিধিকে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘ভাই আপনি কি আপনার ভাতিজারে মারবেন? আরিফের মা বাবাকে জিজ্ঞাসা করেন তারাই বলতে পারবে আরিফকে কারা মেরেছে। তার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষরা যে অভিযোগ করছে তা সম্পুর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট বলে দাবী করেন। আরিফ কে আঘাত করার সময় তিনি ঘটনাস্থলে থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, আরিফকে যারা মেরেছে তারা সংখ্যায় বেশী হওয়ায় আমি বাধা দিয়ে আটকাতে পারিনি, আমি নিজেও আহত হয়েছি, আরিফের বাবাও তো আঘাত পেয়েছে’।
এদিকে প্রতিবন্ধি আরিফ হত্যাকান্ড নিয়ে এলাকায় রহস্যের জট বেঁধেছে। লোকমুখে চলছে নানা গুঞ্জন। প্রতিবন্ধি কিশোর কথা বলতে পারতো না, ঠিকমত হাঁটতে চলতে পারতো না সে কিভাবে বাবার বিপদে তার কাছে গেল? ঘটনার পর আরিফকে হাসপাতালে না নিয়ে কেন অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে রাখা হলো? সেকি ঘটনাস্থলেই মারা গেছে নাকি হাসপাতালে নেয়ার পথে না অন্য কোথাও রেখে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। এ বিষয়ে খুঁজ নিলে বেরিয়ে আসবে মূল ঘটনার কারন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ মার্চে এলাকায় সঞ্জব আলী নামে এক পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তি খুন হয়। সঞ্জব আলী হত্যাকান্ডে তার ভাই মিন্নত মিয়া বাদী হয়ে ১৫ জনকে আসামী করে থানায় মামলা দায়ের করেন। এই খুনের মামলার আসামীর তালিকায় রয়েছে নিহত আরিফের বাবা আরবেশ আলীর নাম। অন্যদিকে চাচা ইয়াকুত আলী ছিলো পুলিশের চোখে সন্ধিগ্ধ। আরিফের বাবা আরবেশ আলী সম্প্রতি জামিনে বেড়িয়ে এসেছে বলে জানা গেছে। আরিফ হত্যাকান্ডের একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীরা ঘটনার সময় আরিফকে মারপিট করতে ইয়াকুত আলীকে দেখলেও ইয়াকুত বলেছে আরিফের খুনিদের নাম। যারা সবাই সঞ্জব আলী হত্যামামলার বাদী মিন্নত আলীর আত্মীয় স্বজন।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আশফাকুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, বিষয়টি তদন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এ হত্যাকান্ডের মধ্যে দিয়ে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর চেষ্টা হতে পারে এমন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, সব দিকই যাচাই বাছাই করে দেখা হচ্ছে, তবে এখনই চুড়ান্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।
শ্রীমঙ্গল থানার ওসি কে এম নজরুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, মেম্বারের বাড়িতে ইফতার পার্টি ছিল। ইফতার পার্টিতে হাজী মনির মিয়া ছিলেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। ঘটনার রাতেই আমার পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। রাতে পুলিশ খোঁজ নিয়ে আমাকে জানিয়েছে মুলতঃ মহিলারা পুকুর ঘাটে বাসন মাজা নিয়ে তারা নিজেরা নিজেরা মধ্যে ঘটনার সূত্রপাত হয়। এখন ওই ঘটনাকে ডাইভার্ড করার চেষ্টা করছে এরকম শোনা যাচ্ছে।
এ দিকে ঘটনার সাড়ে ৫০ ঘন্টা পর নিহত প্রতিবন্ধি আরিফ বাবা আরবেশ আলী বাদী হয়ে শ্রীমঙ্গল থানায় ১৮ জনের নাম উল্লেখ করে ও ৭/৮জনকে অজ্ঞাত আসামী করে ২৬ জুন রাত ১০.০৫ মিনিটে মামলা দায়ের করেন। মামলা গ্রহনের আগেই অর্থাৎ ২৫ জুন রাতে আব্দুল খালিক ও খালেদ মিয়াকে গ্রেফতার করে। পরে এ দুজনকে এজহারে অন্ত:ভুক্ত করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে যে সিএনজি অটো রিক্সায় আহত আরিফকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে সেই অটো রিক্সার ড্রাইভার সহ অন্যান্যদের ভাষ্য কি? এসব প্রশ্নের সঠিক কোন জবাব মিলছে না। কেউ কেউ বলছেন প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে পুকুর ঘাটে মহিলাদের বাসন ধোয়ার মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরিফকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হতে পারে। আবারও কেউ বলছেন গত কয়েক মাস আগে হাজীপুর গ্রামের সঞ্জব আলী নামে এক পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তি খুনের ঘটনায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এই হত্যাকান্ড ঘটে থাকতে পারে।
এলাকাবাসী মনে করেন সুষ্ট তদন্ত করে প্রতিবন্ধি আরিফ হত্যার প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করতে না পারলে হাইল হাওরের হাজীপুর এলাকায় এ ভাবে খুনের মতো জগন্যতম অপরাধ সহ অন্যান্য অপরাধ বাড়তে থাকবে।
মন্তব্য করুন